শীতের পরশ মেখে স্বপ্নের কংসাবতী মায়াবী হয়ে ওঠে, স্বপ্নের নদী এমন সুন্দর হলে অনন্তকাল ঘুমিয়ে থাকা যায়। এখনো মনে আছে ইংরেজির সাল ২০১৭ হবে, প্রায় এক বছর গ্রাম থেকে বহু দূরে থাকার পর প্রথম বাড়ি ফিরেছি। বহু প্রতীক্ষার পরে রং, তুলি আর ক্যানভাস নিয়ে এক ছুটে প্রিয় নদীর কাছে। কংসাবতীর ফুলের উপত্যকা তখন মিষ্টি রোদ গায়ে মেখে বেশ উজ্জ্বল দেখাচ্ছে। ক্ষেতের এক পাশে মেঠো রাস্তার ওপর ইজেল আর ক্যানভাস লাগিয়ে ছবি টা ধরার চেষ্টা করছি। নদী ঘাটে স্নান সেরে দেহাতি মানুষের দল মিঠে রোদ মেখে আলপথ ধরে বাড়ি ফিরছে। আসে পাশে ফুটে আছে প্রচুর ফুলের বাহার, মনে মনে ভাবলাম চাষী দের হাতের সৃষ্টি পৃথিবীর শ্রেষ্ট শিল্পীদের ও অসাধ্য। হাল্কা উত্তরে বাতাসে গাঁদা ফুলের মিষ্টি সুবাস ছড়িয়ে পড়ছে চারিদিকে। ঠিক পাশের ক্ষেতে গাঁদা ফুল তুলে চলেছে এক গ্রাম্য বধূ। এক একটা হলদে গাঁদা দুই আঙ্গুল দিয়ে সুন্দর ভাবে তুলে নিচ্ছে অসাধারণ দক্ষতায় আর টুক টুক করে ধ্বনি তৈরি হচ্ছে তাতে। একটা বিষয় লক্ষ্য করলাম গাছ গুলি নাড়াচাড়া করার ফলে ফুলের সুবাসের সঙ্গে মাঝে মাঝে একটা সবুজে গন্ধ নাকে ভেসে আসছে। এটা আমার খুব পরিচত একটা সুবাস, এমনি ছোট ছোট বিষয় গুলির জন্য মন পাগল হয়ে ওঠে, মনে হয় কংক্রিট এর দুনিয় ছেড়ে চলে যাই নদীর কাছে। ধীরে ধীরে সূর্য যখন মধ্য গগনে পৌঁছল, রোদের ছটা তখন গাছের ফাঁক দিয়ে ক্যানভাস এর ওপর পড়েছে। ওপেন এয়ার এ যারা কাজ করে তারা জানে যে রোদ থেকে মাথা না বাঁচলেও ছবি টা বাঁচানো খুব দরকার। অগত্যা আসে পাশে তাকিয়ে দেখলাম দুই সঙ্গী কোন দিকে আছে, দেখা না পেয়ে বার দুই হাঁক দিলাম তাতে কাজ হলো দেখলাম ফটোগ্রাফার ভাই মোবাইল টা কানে গুঁজে আলের ওপর বসে কারো সঙ্গে কথা বলছে। দ্বিতীয় সঙ্গী সমস্যার কথা শুনে আমার জাপানি উলফা কাটার টা নিয়ে কলা বাগানের দিকে চলে গেল, জানতে চাইলে বলেছিল একটু অপেক্ষা করতে। কিছুক্ষন পরে সে বেরিয়ে এল বেশ কিছু কলাপাতা নিয়ে আমি বললাম এটা ঠিক করলি না, সে বলল আরে ভাই তোর ফালতু জ্ঞান শুনতে পারবো না। তারপর এক খানা বাঁশ পুঁতে তাতে পাতা বেঁধে ছায়ার সৃষ্টি করা হল। যাই হোক এত কিছু কর্ম কাণ্ডে ফটোগ্রাফার কিন্তু কানে ফোন টা গুঁজে রেখেই কিছু টা সাহায্য করেছে, মনে মনে বেশ বিরক্ত হয়ে ছিলাম বটে কিন্তু পরে বুঝেছিলাম সে একটা মস্ত বড় কাজে ব্যস্ত ছিল। যাই হোক এমন সুন্দর উপত্যকায় যদি এমন সুন্দরী রমণী ফুল তুলতে থাকে তবে ছবি আঁকা যে কিছু টা হলেও বিঘ্নিত হবে সেটা ওই বয়সে অস্বাভাবিক কিছুই নয়। তার পর সূর্য যখন কিছুটা পশ্চিমে ঢলে পড়েছে তখন শরীর বলছে এনার্জির প্রয়োজন। কিন্তু আজকে আসার সময় খাওয়ার নিয়ে আসতে বেমালুম ভুলে গেছি, এরকম ভুলে যাওয়া ব্যাপার টা যে আমার একটা বৈশিষ্ট্য সেটা দুই সঙ্গী ভালো করেই জানে। আবার আমরা যে জায়গা তে সেদিন কাজ করছি সেটা জাতীয় সড়ক থেকে উত্তরে জানাবাড় পেরিয়ে নদীর পূর্ব দিকের তীরে। আসে পাশে খাওয়ার দোকান তেমন কিছু নেই যদিও বা এক খানা আছে সেও বিকেল চারটের পর খুলবে, তখন অবশ্য সু স্বাদু তেলেভাজা পাওয়া যাবে। আঁকতে আঁকতে এই সব ভাবছি হঠাৎ দেখি ফটোগ্রাফার রাস্তার দিক থেকে হেঁটে আসছে, মুখে সাফল্যের হাসি আর হাতে মস্ত বড় একটা স্টিল এর কৌটো। বললাম কি ভাই কি ব্যাপার? সে মৃদু হেসে বলে হে হে দাদা পিঠা খাবে পিঠা, দুধ পুলি? আমার পেটের যা অবস্থা তার ওপর দুধ পুলি, চুপচাপ হাত বাড়িয়ে দিলাম। তার পর কচি কলাপাতায় ঢেলে দুধ পুলি আর চাপা কলের জল খেয়ে আরাম করে জানতে চাইলাম, ভাই এই অচেনা জায়গায় পিঠা কোথায় পেলি? কোনো উত্তর না দিয়ে কৌটো টা নিয়ে নদীতে চলে গেল। ফিরে এসে বলেছিল ব্রাহ্মণ বাড়ির পিঠা বুঝলে,কৌটো টা তাই ধুয়ে দিলাম, এই বলে রাস্তার দিকে চলে গেল। দূর থেকে দেখতে পেলাম স্কুটি নিয়ে নায়িকা কৌটো ফেরতের অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে। আমার দ্বিতীয় সঙ্গী বলেছিল শালা পাপে ওর পেট খারাপ হবে ব্রাহ্মণ বাড়ির থেকে দুধ পুলী খওয়া। আমি বললাম ভাই দেখ তিন জন মিলে খেয়েছি পাপ ওর একার কেন হবে? কোনো উত্তর না দিয়ে একখান বিড়ি দিয়ে বলেছিল ছাড় এখন শরীর টা হেলিয়ে দিয়ে শান্তি তে বিড়ি খাই। সূর্য তখন দিগন্তে হেলে পড়েছে, ঠান্ডাটা বাড়তে শুরু করেছে। এর পর ক্যানভাস টার কাছে আর যেতে মন চাইলো না। যখন আমি ছবি টা শুরু করেছিলাম তখন এত মানুষ ছিল না আশেপাশে, এখন অনেক চাষী ব্যস্ত মাঠের কাজে। যারা একটু দুপুর থেকে ফুল তুলেছিল তারা অনেকে ফিরে গেছে ঘরে, আবার কেউ মাথায় বোঝা নিয়ে বাড়ির পথ ধরেছে। মাটির আলপথে মাথা রেখে অনেক দিন পর এত বড় আকাশ দেখছি। নীল আকাশে মাথার ওপরে কিছু চামচিকা ঘুরে বেড়াচ্ছে। দূরে গ্রামের গোয়াল ঘর থেকে ধোঁয়ার কুণ্ডলী আকাশে মিলিয়ে যাচ্ছে। কোনো এক সময় মন খারাপের ছোট ছোট কারণ গুলো নদীর সঙ্গে ভাগ করে নিয়েছি, কারণ তখন এসব শোনার মত ছিল না কেউ। আজকে ছোট ছোট দুঃখ গুলো থেকে মুক্তি পেতে গিয়ে আস্ত নদী খানা হারিয়ে গেল জীবন থেকে। আমার ফটোগ্রাফার সঙ্গী টি এখন ব্যাস্ত হয়ে চাষী দের কর্ম কান্ড ফ্রেম বন্দী করে নিচ্ছে। সূর্য তখন একেবারে দিগন্তের রেখা ছুঁয়ে ফেলেছে। নদীর ওপর একটা কুয়াশার আস্তরণ ঢেকে যাচ্ছে ধীরে ধীরে। মন না চাইলেও আজ ফিরতে হবে, যদিও নদীতে রাত্রি যাপন যে করিনি তা নয় তার গল্প হবে আর এক দিন। এখন ফিরে যাওয়ার পালা। আমাদের মোটর সাইকেল রাখা ছিল রাস্তার ওপরে। সেখানে এসে সবাই মিলে রতন খুড়োর দোকানে পিঁয়াজি খেলাম। আপনারাও খেতে চাইলে বলবেন, রতন খুড়ো দারুন পিঁয়াজি ভাজে।
🙏🙏 ©হিরন্ময়
কংসাবতী পর্ব
Comments